শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪১ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বা বিসিবি নির্বাচন ঘিরে গত কয়েকদিন ধরেই চলছিল নানা অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ। এমন আলোচনার মধ্যেই আবার গুঞ্জনও ছিল আলোচিত ক্রিকেটার তামিম ইকবাল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। শেষ পর্যন্ত সত্যিও হয়েছে সেই গুঞ্জন।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে বুধবার সকাল সোয়া দশটার দিকে বিসিবিতে গিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন তামিম।
এসময় তিনি এবারের বিসিবি নির্বাচনকে ‘ফিক্সিং’ বা পাতানো নির্বাচন আখ্যা দিয়ে বললেন, ‘এই নির্বাচন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের জন্য একটা কালো দাগ হয়ে রইলো।’
এসময় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ওপেনার বলেন, ‘যারা বোর্ডে আছেন, তাঁরা চাইলে এভাবে নির্বাচন করতে পারেন, জিততেও পারেন। তবে ক্রিকেট আজ শতভাগ হেরে গেল।’
নির্বাচনে ‘সরকারি হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে’ প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘটনাও ঘটেছে। শেষ দিনে বিভিন্ন পদে ১৬ জন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ফলে অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
এর ফলে জেলা-বিভাগের ক্যাটাগরিতে ১০টি পরিচালক পদে ছয়জন জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সংশ্লিষ্ট কয়েকজন সাবেক ক্রিকেটার এবং ক্রীড়া বিশ্লেষকের সাথে এ নিয়ে কথা হয় বিবিসি বাংলার। তারা বলছেন, বিসিবি নির্বাচন ঘিরে গত কয়েকদিনে দফায় দফায় পর্দার আড়ালে বিভিন্ন বৈঠক ও আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন তামিম ইকবাল নিজেও।
মঙ্গলবার দুপুরে তৃতীয় বিভাগ বাছাই ক্রিকেট থেকে উঠে আসা ‘বিতর্কিত’ ১৫টি ক্লাবের কোনো প্রতিনিধির নাম চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কার্যক্রম স্থগিত করতে হাইকোর্ট নির্দেশনা দেয়।
ক্রীড়া বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, মূলত ওই ১৫জন ক্লাব প্রতিনিধি ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়াই তামিম ইকবালের সরে দাঁড়ানোর অন্যতম একটি কারণ।
ক্রীড়া বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক এম এম কায়সার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ক্রিকেট হেরে গেছে বলে তামিম ইকবাল মন্তব্য করলেও আমি মনে করি নির্বাচনের মতো একটা ছোট বিষয়ের সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে মেলানোর কোনো মানে হয় না। এখানে ক্রিকেট হারেনি, নেগোসিয়েশনে তামিম ইকবাল হেরে গেছে।’
আগামী ছয়ই অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে এবারের বিসিবি নির্বাচন। এবার কাউন্সিলরের ভোটে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ২৫ জন পরিচালক নির্বাচিত হবেন। আর তাদের ভোটেই বিসিবির নতুন সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচন করা হবে।
‘পাতানো’ নির্বাচনের অভিযোগ কেন?
চার বছর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বশেষ বিসিবি নির্বাচন। বুধবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে পর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে বিসিবির নির্বাচন কমিশন।
বিসিবির বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলামও ক্যাটাগরি-১ এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। একই সাথে সভাপতি হিসেবে তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন বুলবুল। তার বিরুদ্ধেই একই পদে লড়ার ঘোষণা আগে থেকেই দিয়েছিলেন তামিম ইকবাল।
কিন্তু বুধবার সকালে এসেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে তামিম ইকবাল এবারের বিসিবি নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভের কথা প্রকাশ্যে আনেন।
বুধবার সকালে তামিম ইকবাল গণমাধ্যমে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমিসহ ১৪-১৫ জনের মতো মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছি। শুরু থেকে বলে আসছি যে নির্বাচন কোন দিকে যাচ্ছে। যখন যেমন মনে হচ্ছে, যখন যা মনে হচ্ছে তখন তা করা হচ্ছে। এটা আসলে নির্বাচন নয়। ক্রিকেটের সাথে এটা কোনভাবে মানায় না।’
বাকি আরো যারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করছে তাদের কথা উল্লেখ করে জাতীয় দলের সাবেক এই ওপেনার বলেন, ‘যখন ইসি তালিকা দেবে আজকে কারা কারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছে, তাদের নামগুলো দেখলেই আপনারা বুঝতে পারবেন যে তারা সবাই তাদের জায়গা থেকে হেভিওয়েট। তাদের ভোট ব্যাংক খুব স্ট্রং।’
‘এটা হচ্ছে আমাদের একটা প্রটেস্ট (প্রতিবাদ) যে, এই নোংরামির মধ্যে আমরা থাকতে পারবো না। এখানে ধরেন বিভিন্ন অনেক ধরনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে এই নোংরামির পার্ট (অংশ) আমরা হবো না।’
বাংলাদেশের সাবেক এই ক্যাপ্টেন এসময় দাবি করেন যে, নির্বাচনের পরিবেশ দেখে তিনি ছাড়াও আরো অনেকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদেরকে চাপ সৃষ্টি করে ভোটে রাখা হয়েছে।
তামিম বলেন, ‘এই যে পনেরো জনের মতো মনোনয়ন প্রত্যাহার করছে, এটা কিন্তু উল্লেখযোগ্য নম্বর। যারা বোর্ডে আছেন তারা যদি এভাবে করে নির্বাচন করতে চান করতে পারেন। জিততেও পারেন। কিন্তু আজকে ক্রিকেট হান্ড্রেড পার্সেন্ট হেরে গেছে, এটা নিয়ে সন্দেহ নাই।’
এক সময়ের জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটার এই সময়ে এসে ফিক্সিং বা পাতানো ভোটের অভিযোগ তুলে এই সংবাদ সম্মেলনেই দাবি করেছেন, এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে একদিকে যেমন ক্রিকেট হেরেছে, অন্যদিকে তা ক্রিকেটে কালো দাগ লাগিয়েছে।
তামিম কেন সরে দাঁড়ালেন?
এবারের বিসিবি নির্বাচন নিয়ে নাটকীয়তা কিংবা রাজনীতি কম হয়নি। এ নিয়ে গত কয়েকদিন দেশে নানা আলোচনা-সমালোচনাও দেখা গেছে।
বিসিবিতে নির্বাচিত হতে পর্দার আড়ালে যেমন আলোচনা হয়েছে, তেমনি প্রকাশ্যেও দেখা গেছে নানা মতবিরোধ।
এই যেমন এবারের নির্বাচনে কারা নির্বাচিত হবেন তা নিয়ে বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের মধ্যে নানা আলোচনার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে পরিচালক পদে ভোটে অংশ নিয়েছেন ক্রিকেট বোর্ড সংশ্লিষ্ট এমন একজন প্রার্থী বিবিসি বাংলার কাছে দাবি করেছেন, গত কয়েকদিন এ নিয়ে বেশ কয়েক দফায় মিটিং হয়েছে। ভোটারদের প্রভাবিত করার ঘটনাও ঘটেছে। সে সব আলোচনায় কখনো কখনো তামিম ইকবাল নিজেও ছিলেন।
নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর পর গত মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনের বা দুদকের তদন্ত চলা ১৫টি ক্লাবকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিসিবির নির্বাচন কমিশন। নানা কারণে ওই ক্লাবগুলো বিতর্কিত ছিল বলেও বিসিবি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
যে কারণে খসড়া ভোটার তালিকা থেকে ওই ক্লাবগুলোকে বাদ দেওয়া হয়। পরে ক্লাবগুলো আবারও বিসিবি নির্বাচনে ভোটাধিকার ফেরত পেতে আদালতে আপিল করে ভোটার হিসেবে বৈধতা পায়। পরে গতকাল মঙ্গলবার ওই ক্লাবগুলোর ভোটাধিকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ আপিল করেন সাবেক বিসিবি সভাপতি ও নির্বাচনে পরিচালক পদপ্রার্থী ফারুক আহমেদ। পরে হাইকোর্টের রায়ে আবারো ওই ১৫টি ক্লাবকে বাদ দেওয়া হয়।
বিসিবি সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা ও ক্রীড়া বিশ্লেষকদের সাথে এটি নিয়ে কথা বলে যতটুকু বোঝা গেছে, তার সারমর্ম অনেকটা এমন যে, মঙ্গলবার হাইকোর্টের রায়ের পরই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি অনেকেই ধারণা করছিলেন।
এ নিয়ে নানা দেন-দরবার ও দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে গত সোম ও মঙ্গলবার। শেষ পর্যন্ত বুধবার সকালে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন তামিম ইকবাল।
সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক এম এম কায়সার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বাস্তবতা হলো তামিম এই নির্বাচনে জেতার জন্য এবং বড় চেয়ার পাওয়ার জন্য সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের সঙ্গে একধরনের সমঝোতা এবং ভাগাভাগির প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছিলেন। এনিয়ে গত সোমবার এবং মঙ্গলবার রাতে তারা লম্বা সময় জুড়ে বৈঠক করেছিলেন। শুরুতে সেই বৈঠকে উভয়পক্ষের হাসিমুখ থাকলেও শেষপর্যন্ত আর আর স্থায়ী হয়নি। কারণ ভাগবন্টনের সমঝোতা যে হলো না।’
অন্যদিকে, এই নির্বাচনে বিএনপির চারজন নেতার ছেলেরা প্রার্থীও হয়েছেন। সরকারের সাথে সেটি নিয়ে পর্দার অন্তরালে এক ধরনের সমঝোতার খবরও প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে।
মি. কায়সার বলছিলেন, ‘তামিম তার প্যানেলে বিএনপির ‘পলিটিক্যাল কিডসদের’ জায়গা দিতে গিয়ে ক্লাবের অনেক পরীক্ষিত এবং তার সমর্থনে এতদিন শ্লোগান তোলা ক্রিকেট সংগঠকদের জায়গা দিতে পারেননি। নিজের প্যানেলে এনিয়ে তামিমকে বড় সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সরকার সমর্থিত পক্ষের সঙ্গে সমঝোতাও শেষ পর্যন্ত না হওয়ায় চারদিকের তুমুল চাপের মধ্যে পড়তে হয় তামিমকে।’
তার মতে, তামিম সত্যিকার অর্থে এই নির্বাচনে বিরুদ্ধপক্ষের সঙ্গে সমঝোতায় বা ভাগাভাগিতে এবং নিজের প্যানেল সাজানোর পরিকল্পনায় হেরে গিয়েই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।