বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০০ অপরাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক : সম্প্রতি পত্রিকার কিছু খবরের শিরোনামে একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়।এক, বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে দায়ের করা একটি মামলার রায়ে ফয়সালা হয় যে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি এবং ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হলেন শেখ আবদুল হাকিম। অনেকের জন্যই খবরটি বেশ চাঞ্চল্যকর এবং ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের মতোই রোমাঞ্চে ভরা। কারণ আমাদের সবারই ধারণা যে মাসুদ রানার স ষ্টা যেমন কাজী আনোয়ার হোসেন, সিরিজগুলোর লেখকও তিনি। কিন্তু কপিরাইট অফিসের রায়ে শেখ আবদুল হাকিমকেই মাসুদ রানা সিরিজের সর্বাধিক বইয়ের রচয়িতা ও স্বত্বাধিকারী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।
দুই,‘সারেগামাপা’ খ্যাত মাঈনুল আহসান নোবেল ‘জি বাংলায়’ বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান শিল্পীর বেশকিছু জনপ্রিয় গান গেয়েছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে সুরকার প্রিন্স মাহমুদের লেখা ও সুরারোপিত কিছু গান। প্রিন্স মাহমুদ অভিযোগ করছেন যে গান গাওয়ার সময় নোবেল সুরকার ও গীতিকারের নাম উচ্চারণ পর্যন্ত করেনি। অধিকন্তু, এমন অভিযোগও রয়েছে যে নোবেল কিছু গান বাণিজ্যিকভাবেও ব্যবহার করেছেন।
তিন, অতিসম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে যে শিল্পী দিলরুবা খানের কণ্ঠে বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গান ‘পাগল মন’।পাসওয়ার্ড ছবিতে গানটির চুম্বক অংশ ‘পাগল মন মন রে, মন কেন এত কথা বলে’ চরণ দুটি ব্যবহার করেছেন ছবির প্রযোজক ও অভিনেতা শাকিব খান। অনুমতি ছাড়া সিনেমায় ওই গানের দুটি চরণ ব্যবহারের কারণে শাকিবের নামে শুরুতে উকিল নোটিস ও পরে কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন হয়েছে—এই মর্মে গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন শিল্পী দিলরুবা খান।
যদিও ঘটনাগুলো মামুলি বলেই সাধারণের কাছে বিবেচিত, একটি দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এসব ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম। উপরের উদাহরণগুলো ‘কপিরাইট’ বা মেধাস্বত্ব রক্ষার বিষয়।আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার মতে, মেধাস্বত্ব হলো কোনো একজনের মনের দ্বারা সৃষ্ট উপাদান, যেমন সাহিত্য ও শৈল্পিক কাজ, ডিজাইন, প্রতীক, নাম বা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ব্যবহূত ইমেজ ইত্যাদি। যেহেতু এসব সম্পদের বাহ্যিক বা ভৌত অস্তিত্ব সহজে দেখা বা বোঝা যায় না, তাই মেধাস্বত্ব রক্ষা করা অনেক কঠিন।
সম্পত্তির (স্থাবর বা মেধাসম্পদ) অধিকারের মর্মার্থ হলো, কারো প্রচেষ্টার সঙ্গে প্রাপ্তির সমন্বয়।যেমন কোনো একজন চেষ্টা ও শ্রম দিয়ে কোনো কাজ করলে সেই কাজের ফল ভোগ করার তার পূর্ণ অধিকার থাকতে হবে। কেউ যদি তার প্রচেষ্টার ফল এককভাবে পাওয়ার নিশ্চয়তা না পায়, উৎপাদনশীল কাজের প্রতি মানুষের অনীহা তৈরি হবে এবং অনুৎপাদনশীল কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যুগে মেধাস্বত্ব সুরক্ষাকে উৎপাদন ও উদ্ভাবনের একটা অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। মেধা ও পরিশ্রমের দ্বারা কোনো কিছু আবিষ্কারের পর যদি কেউ অবৈধভাবে সেটা নকল করে ফেলে, উদ্ভাবনী কাজের প্রতি মানুষ আগ্রহী হবে না। যেমন কোনো প্রতিভাবান লেখকের রচিত পুস্তক যদি অন্য কেউ সহজেই কপি করে স্বল্পমূল্যে বাজারজাত করে, তবে প্রকৃত লেখক তার যথাযথ পারিশ্রমিক পাবেন না। এ পরিস্থিতিতে লেখক বই লেখায় আগ্রহী হবেন না। এতে মেধার যথাযথ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে এবং ব্যক্তি ও সমাজ দুই-ই ক্ষতির সম্মুখীন হবে। মানুষের উপকারী অনেক কাজকর্ম থেকে সমাজ বঞ্চিত হবে।
শুধু উদ্ভাবন নয়, মেধাস্বত্ব রক্ষার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেরও একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।যে দেশের মেধাসম্পদ রক্ষার আইন যত শক্ত এবং প্রায়োগিক, সেই দেশের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হার তত বেশি। মেধাস্বত্ব রক্ষায় উদাসীন মনোভাবের কারণে চীনের সঙ্গে বিশ্বের অনেক দেশেরই সুসম্পর্ক স্থাপনে অনীহা। অধিকন্তু, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের একটা কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের মেধাসম্পদ রক্ষায় চীনার ঢিলেঢালা ভাব। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের শুরুর একটা ঘটনা দুই দেশের বৈরী মনোভাবকে অনেক প্রভাবিত করেছিল।
বেইজিংভিত্তিক ‘সিনোভেল’ হলো চীনের উইন্ড টার্বাইন উৎপাদনের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান।সিনোভেল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটভিত্তিক সফটওয়্যার নির্মাতা ‘আমেরিকান সুপারকন্ডাক্টর’ বা ‘এএমএসসি’র একজন বড় ক্রেতা। সিনোভেল এএমএসসি থেকে ১০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সফটওয়্যার আমদানি করে এবং আরো ৭০ কোটি ডলার মূল্যের সফটওয়্যার আমদানি করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। এ অবস্থায় সিনোভেল এএমএসসির সাবেক দুই কর্মচারীকে তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়। এ নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য ছিল এএমএসসির উইন্ড টার্বাইন তৈরির ট্রেড-সিক্রেট এবং সোর্স কোড চুরি করা। সিনোভেল এ মিশনে অনেকটা সফলও হয়। ফলে এএমএসসির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার। এএমএসসির উৎপাদন ও বিক্রয় এত বেশি কমে যায় যে প্রতিষ্ঠানটি তার ৭০ শতাংশ লোকবল কমাতে বাধ্য হয়। মেধাস্বত্ব আইনে দায়ের করা মামলার রায়ে মার্কিন অ্যাটর্নি বলেছিলেন যে সিনোভেল এএমএসসির মেধাসম্পত্তি চুরি করে প্রতিষ্ঠানটিকে একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। বিষয়টি যে শুধু চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যদ্বন্দ্বের একটি প্রধান নিয়ামক ছিল তা নয়, দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাদের নিজ নিজ দেশের মেধাস্বত্ব অধিকার আইন এবং তার প্রয়োগ নিয়ে বিবৃতি দিতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।
এটা বলা বাহুল্য, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মেধাস্বত্বের আবিষ্কার এবং তার ব্যবহারের মাত্রা অনেক গুণ বেড়ে গেছে, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর শেষের দুই দশক থেকে। তবে মেধাস্বত্ব অধিকার রক্ষার তাগিদ সবসময়ই ছিল।মেধাস্বত্ব রক্ষায় জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের আইন রয়েছে। বাংলাদেশে মেধাস্বত্ব অধিকার রক্ষায় ১৮৮৩ সালে প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক আইন করা হয়। ১৯১১ সালে সেটা বাতিল করে প্যাটেন্ট ও ডিজাইন আইন এবং ১৯৪০ সালে ট্রেডমার্ক আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০০৩ সালে এ দুই আইন পরিমার্জিত করে একত্র করা হয় ডিপার্টমেন্ট অব প্যাটেন্ট, ডিজাইন, অ্যান্ড ট্রেডমার্ক সৃষ্টির মাধ্যমে। মেধাসম্পদ রক্ষায় বর্তমানে বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক আইন, ২০০৯ (২০১৫ সালে সংশোধিত) এবং কপিরাইট আইন, ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) বলবৎ আছে।
এছাড়া বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনের স্বাক্ষরকারী।যেমন ১৯৮৫ সালে বিশ্ব মেধাস্বত্ব প্রতিষ্ঠান (ডব্লিউআইপিও) প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল। আবার শিল্প সম্পত্তি সংরক্ষণে বাংলাদেশ প্যারিসভিত্তিক কনভেনশন এবং সাহিত্য ও শৈল্পিক কর্মরক্ষায় সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বার্ন কনভেনশনের সদস্য। এছাড়া বাংলাদেশ ‘ট্রেড রিলেটেড আসপেক্ট অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট’ বা ট্রিপস এবং ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’ (ডব্লিওটিও) চুক্তির সক্রিয় স্বাক্ষরকারী দেশ।
প্যারিস ও বার্ন কনভেনশনের সুফল দেখতে চলুন একটু পেছনে ফিরে যাই। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইল সের গাওয়া ‘ফিরিয়ে দাও আমার প্রেম তুমি’ ভারতীয় ব্লক বাস্টার মুভি মার্ডারের সাউন্ডট্র্যাকে নকল করে সংযোজন করা হয়েছিল। মার্ডার ছবিতে ‘জানা জানে জানা’ শিরোনামে একটা গান ছিল, যা ‘ফিরিয়ে দাও আমার প্রেম তুমি’ গানের নকল। আলাদা বলতে শুধু বাংলা ভাষার স্থলে হিন্দি ভাষা (গানটি এখনো ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে, গানের মিউজিক শুনে খুব সাধারণ একজন শ্রোতারও মনে যে হবে যে এটা মাইল?সের গান)। মাইল?স ব্যান্ডের সদস্যরা কলকাতার আদালতে মামলা করেন এই মর্মে যে তাদের গানটি নকল করে ছবিতে সংযোজনের মাধ্যমে বার্ন ও প্যারিস কনভেনশনের ১১ ও ১৪ নম্বর ধারায় কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। দুই পক্ষের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের পর আদালত নির্দেশ দেন মার্ডার ছবি থেকে যেন গানটি বাদ দেয়া হয়। সেই সঙ্গে এ গানসংবলিত কোনো মিউজিক ক্যাসেট বা ডিস্ক উৎপাদন, বিক্রয়, বিতরণ বা বিপণনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। আদালতের এ রায়কে মাইলসের সদস্যরা তাদের জয় হিসেবেই দেখেছিলেন।
তবে উন্নয়নশীল দেশে মেধাস্বত্ব অধিকারকে শুধু আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায় না।এখানে অনেক সময় মেধাস্বত্ব সুরক্ষা আইন বিদ্যমান, কিন্তু জনগণের সচেতনতার অভাবে সেটার প্রয়োগ অধরাই থেকে যায়। যেমন কাজী আনোয়ার হোসেন ও শেখ আবদুল হাকিম কোনো রকম লিখিত চুক্তি ছাড়াই ‘মাসুদ রানা’ প্রকল্পে একসঙ্গে কাজ করেছেন। তাদের মাঝে হয়তো কোনো মৌখিক চুক্তি ছিল। আবার পাসওয়ার্ড ছবিতে পাগল মন গানের দুই চরণ ব্যবহার করার জন্যও নাকি মৌখিকভাবে অনুমতি নিয়েছিল। আসলে এগুলো মৌখিক কোনো বিষয় নয়। যথাযথ চুক্তি করে মেধাস্বত্ব রক্ষা করতে হবে। এদিকে পাগল মন গানটি নিয়েও আছে অনেক কথা। এ গানের কথা ও সুর নাকি সংগৃহীত এবং এটি একটি লোকগান হিসেবেই পরিচিত। সুতরাং বর্তমানে যাদের নামে গানটির মেধাস্বত্ব আছে, আদতে তারা গানটির স্বত্ব দাবি করতে পারেন না। সমস্যা হলো, গানটির প্রথম গীতিকার ও সুরকার হয়তো জানতেনই না মেধাস্বত্ব আইন এবং তার ব্যবহার। এখানেই জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব প্রকাশ পায়।
তদুপরি অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে মেধাস্বত্ব অধিকার রক্ষা খুব দুরূহ। মনে করেন আপনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।বিদেশী কোনো দামি লেখকের বই প্রয়োজন। বিদেশে মুদ্রিত আসল বইটির দাম নিশ্চয় অনেক বেশি। বাজারে খোঁজ করে কম দামে একটা ফটোকপি বই কিনে ফেলা যায় অনায়াসেই। আবার অনেক বিদেশী দরকারি সফটওয়্যার নামমাত্র মূল্যে দোকান থেকে কেনা যায়। এখন বলা হবে যে কপিরাইট আইন যদি সত্যি সত্যি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে দেশের অনেকেই সুলভ মূল্যে খুব দরকারি সফটওয়্যার, বই বা এ-জাতীয় মেধাসম্পদ ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হবে। একথা যেমন সত্য, তার আরেকটা দিকও আছে। কপিরাইট আইনের প্রয়োগে এসব মেধাসম্পদের আর্থিক মূল্য অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবে। এ মূল্যই হয়তো দেশের হাজার হাজার তরুণ বিদেশে পাড়ি না দিয়ে দেশে বসেই বিভিন্ন সফটওয়্যার তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হবে। তেমনিভাবে দেশের অনেক মেধাবী হয়তো দেশে বসেই আন্তর্জাতিক মানের বই লিখবে। এতে একদিকে যেমন দেশের মেধার বিকাশ ঘটবে, অন্যদিকে মেধা পাচারের মতো ঘটনাও অনেক কমে আসবে।
ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, অর্থনীতি ও ফিন্যান্স বিভাগ,নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান dulal@unizwa.edu.on