বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৬ অপরাহ্ন
লায়লা নাজনীন : অনেক ফ্রেশারের মধ্যে দেখেছি সফট স্কিল নিয়ে কিছু কনফিউশন আছে। স্কিল কী তাতো আমরা সবাই জানি কিন্তু হার্ড স্কিল আর সফট স্কিলের মধ্যে তফাৎ তা অনেকে বুঝি না- আসুন হার্ড স্কিল এবং সফট স্কিল নিয়ে আমাদের বেসিক কনসেপ্টটা ক্লিয়ার করি।
হার্ড স্কিল
হার্ড স্কিল হলো প্রযুক্তিগত জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ যা আমরা আমাদের কর্মজীবন বা শিক্ষাসহ জীবনের যে কোনও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করি. যেমন ধরুন: যে ব্যক্তিটি ষ্টার সিনেপ্লেক্সের কাস্টমার সার্ভিসে জব করে, রেগুলার টিকিট বা ফুড সেল করে তাকে অবশই পয়েন্ট অব সেলসের সিস্টেম সম্পর্কে জানতে হবে (এখানে পয়েন্ট অব সেলস সিস্টেম জানা হচ্ছে হার্ড স্কিল যে ব্যক্তি কোথাও অ্যাকাউন্টিংয়ের ক্লাস করান বা কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টসে কাজ করেন তাকে অবশই মাইক্রোসফট এক্সেল জানা থাকতে হবে (মাইক্রোসফট এক্সেল জানা হচ্ছে তার হার্ড স্কিল)। আবার গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে যে কাজ করে, তার ডিজাইনিংয়ের বিভিন্ন সফটওয়্যার জানাটা হচ্ছে তার জন্য হার্ড স্কিল বা আইটি সেক্টরে যারা কাজ করে বিভিন্ন আইটি সফটওয়্যার সম্পর্কে জানাটা তাদের জন্য হার্ড স্কিল।
সফট স্কিল
সফট স্কিল হলো আমাদের ব্যক্তিগত অভ্যাস এবং বৈশিষ্ট্য যার প্রভাব শুধু আমাদের ওপরই না আমাদের পারিপার্শ্বিক মানুষের ওপরেও পড়ে এবং আমাদের কাজের সঙ্গে জড়িত। আপনি কতটুকু ক্রিয়েটিভ ওয়েতে চিন্তা করে একটি কাজ কমপ্লিট করতে পারছেন, কীভাবে আপনার টিমকে লিড দিচ্ছেন, বস বা কর্মীদের সঙ্গে কত সুন্দর এবং সাবলীলভাবে কমিউনিকেট করতে পারছেন; সেটাই হচ্ছে আপনার সফট স্কিলস। যেমন যে ব্যক্তিটি পয়েন্ট অব সেলসে কাজ করে, তার কমিউনিকেশন স্কিলস যদি দুর্বল থাকে তবে কাস্টমার তার থেকে প্রোডাক্ট কিনবে না (এখানে কমিউনিকেশন স্কিল হচ্ছে তার সফট স্কিল) আবার যে ব্যক্তিটি হিসাববিভাগের কাজের জন্য মাইক্রোসফট এক্সেল নিয়ে কাজ করছেন, সময় মতো কাজ জমা দিতে না পারলে তার পারফরমেন্স খারাপ হবে (এখানে টাইম ম্যানেজমেন্ট হচ্ছে তার সফট স্কিলস)।
সেলফ অ্যাসেসমেন্ট
আপনাকে যে যাই বলুক না কেন আপনি যদি নিজেকে সময় দেন এবং সঠিকভাবে সেলফ অ্যাসেসমেন্ট করতে পারেন, তবেই আপনি বুঝতে পারবেন আপনার মধ্যে কী কী জিনিসের ঘাটতি আছে। সেলফ অ্যাসেসমেন্ট-এর কিছু নিয়ম আছে যেমন ১. কোনো কাজ করার সময় নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে এই কাজটি আমি কতটুকু জানি? ২. আমাকে এই কাজটি কীভাবে করতে হবে ৩. কাজটি করার পর যাচাই করতে হবে কোথায় কোথায় ভুল করলাম এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে সংশোধন করতে হবে। যেমন কোথাও ও ইন্টারভিউতে যাওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন- আপনি সেই পদের জন্য যোগ্য কিনা, সেই কোম্পানির জব ডেসক্রিপশন অনুযায়ী নিজের মধ্যে যাচাই করে দেখুন যে, কোন কোন বিষয়গুলোর আপনার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল রয়েছে? অর্থ্যাৎ সেলফ অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে আপনাকে ঠিক করতে হবে যে, নিজের মধ্যে কোন কোন অভ্যাস অর্জন করতে হবে এবং কোন বিষয়গুলো বর্জন করতে হবে।
ইন্টারপার্সোনাল স্কিলস
ইন্টারপার্সোনাল স্কিলস হলো দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে চিন্তাভাবনা, ধারণা, অনুভূতি এবং আবেগের সরাসরি বিনিময় প্রক্রিয়া। ঘরে বাইরে, স্কুল কলেজ, অবিস অথবা সামাজিক মাধ্যমে যার ইন্টারপার্সোনাল স্কিল যত ভালো সে তত সফল। ইন্টারপার্সোনাল স্কিলকে পিপল স্কিলও বলা হয়। অনেক সময় দেখবেন আপনি আপনার এক বন্ধুর কাছে একটি বই চেয়েছেন কিন্তু সে আপনাকে দেয় নি। অথচ অন্য আরেক বন্ধুকে বইটি দিয়েছে। এখানেই হচ্ছে তার সঙ্গে আপনার ইন্টারপার্সোনাল স্কিলের তারতম্য। সেলফ অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে আপনি আপনার ইন্টারপার্সোনাল স্কিল উন্নতি করতে পারেন। ইন্টারপার্সোনাল স্কিল ইন্টারভিউ প্রসেসে আপনাকে সহায়তা করতে পারে এবং আপনার ক্যারিয়ারের অগ্রগতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ইন্টারপার্সোনাল স্কিল যেমন: অ্যাকটিভ লিসেনিং, রেসপনসিবিলিটি, ডিপেনড্যাবিলিটি, ফ্লেক্সিবিলিটি, এম্প্যাথি। অন্যভাবে বলা যায় যে, ইন্টারপার্সোনাল স্কিল কমিউনিকেশন স্কিলের মধ্যেই পড়ে।
লিডারশিপ
একটু মনে করে দেখুন তো আপনার স্কুল-কলেজ বা অফিস আদালতে এরকম হয়েছে কিনা- কোনো বিষয়ে যখন কারো সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, তখন কোনো এক ব্যক্তি হুট করে সবার সামনে এসে খুব সাবলীলভাবে কথা বলছে এবং আপনার পুরো বিষয়টির দায়িত্ব নিয়ে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কাজটি সম্পন্ন করে দিয়েছে। আপনি আবার ওই ব্যক্তিকে দেখবেন পিকনিক কমিটির অর্গানাইজার হিসেবে কাজ করছে, কখনো দেখবেন কারো দুঃসময়ে তাকে সাপোর্ট দিচ্ছে, মোটিভেট করছে, এটাই হচ্ছে লিডারশিপ কোয়ালিটি। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি লিডার বাই বর্ন হয়, তবে লিডারের কিছু কোয়ালিটি স্কিল ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে আয়ত্ত করা যায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুপারভাইজিং পজিশনে যারা কাজ করেন, তাদের লিডারশিপ নিয়ে কাজ করতে হয়। তাই টিমের লিডার কীভাবে অ্যাক্ট করে তা অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। পুরোপুরি সম্ভব না হলেও আশংশিক অর্জন করতে হবে। একজন লিডারকে হতে হয় প্রাকটিক্যাল, বিচক্ষণ, ন্যায়নিষ্ঠ ও কর্তব্যপরায়ণ। তাকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে টিমের স্বার্থের কথা ভাবতে হয়। এইসব গুণাবলী থাকলে সহজেই টিম মেম্বারদের মনে জায়গা করে নেয়া যায়।
প্লানিং
পুরনো একটি প্রবাদ আছে, ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। ঠিক তাই কোনো কাজ করার পূর্বে তার সঠিক প্লানিং করা জরুরি, সেটা আপনার এডুকেশনের প্লানিংই হোক বা ক্যারিয়ার প্লানিং। অনেক সময়ে আমাদের ভুল পরিকল্পনার জন্য আমাদের অর্থ, সময় এমনকি জীবনও নষ্ট হয়। তাই সঠিক পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে আমাদের জীবনের সফলতা। সাংগঠনিক সাফল্যে পরিকল্পনার গুরুত্ব সম্পর্কিত যথেষ্ট অভিজ্ঞতামূলক প্রমাণ রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি কাজে মনকে প্রাধান্য না দিয়ে ব্রেনকে প্রাধান্য দিয়ে করা উচিত। মনে রাখতে হবে, ইমোশনাল হয়ে কখনো সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। অফিস যাওয়ার পূর্বে দিনের পরিকল্পনা যদি করা যায়, তাহলে প্রায়োরিটি বেসিসে কাজগুলো করতে সুবিধা হয়। ভুলে যাওয়ার প্রবণতা থাকলে পিসির নোটপ্যাড অথবা স্টিকি নোটে লিখে রাখতে পারেন। প্ল্যানিং করে কাজ করার অনেক উপকারিতা, যেমন প্ল্যান করে কাজ করলে কাজের স্ট্রেস কমে, সময়ের অপচয় কম হয়, কাজের রেজাল্ট ভালো আসে। এছাড়াও পরিকল্পনা আপনাকে আরো উৎপাদনশীল করে তুলতে পারে। পরিকল্পনা আপনাকে মননশীলতা বিকাশে সহায়তা করে এবং সর্বোপরি প্লানিং আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।
অর্গানাইজেশনাল স্কিলস
অর্গানাইজেশনাল স্কিলস আমাদের সাহায্য করে কর্মক্ষেত্রে ভুলগুলো দূর করে কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। কর্মক্ষেত্রে যে যত বেশি অর্গানাইজডভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত তার কাজটি তত সুন্দর ও সফল হয়। ডিসঅর্গানাইজড মানুষকে ঘরে-বাইরে কোনো মানুষই পছন্দ করে না। এমপ্লয়ার সেইসব কর্মীদের পছন্দ করে যারা দক্ষ, উৎপাদনশীল এবং কাজ গুছিয়ে ডেডলাইনের মধ্যে শেষ করতে পারে। অনেকের কাজের মধ্যে সিঙ্ক্রোনাইজেশন থাকে না, যে কাজটা আগে করা দরকার সেটি পড়ে করছে। অর্গানাইজেশনাল স্কিলস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় স্কিল, যা আপনাকে কর্মক্ষেত্রে গুরুতর ভুলগুলো এভয়েড করতে সহায়তা করবে, সময় বাঁচাবে, ডেডলাইনের মধ্যে কাজ সম্পাদন করতে সহায়তা করবে, মাল্টিটাস্কিং অ্যাবিলিটি গ্রো করবে। একটা সহজ উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, আপনার অফিসের স্টেপলার মেশিন, রেগুলার ফাইলগুলো এবং আরো প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যদি গুছানো না থাকে, কাজ করার সময় আপনি কিন্তু সেইগুলো খুঁজতে গিয়ে কাজে দেরি করে ফেলবেন। এক পর্যায়ে মেজাজ খারাপ হবে, যার ইমপ্যাক্ট আপনার পারফরমেন্সের ওপর পড়বে, অফিস কলিগদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে এবং অফিস এনভায়রনমেন্ট নষ্ট হবে। তাই অর্গানাইজেশনাল স্কিল ছাত্রজীবন থেকেই ডেভেলপ করা উচিত এবং নিজের ঘরের কাজ দিয়ে তা শুরু করা যেতে পারে। অফিসের কাজগুলোকে সময় অনুযায়ী ভাগ করে নেন, তাছাড়া কাজের যদি ডেইলি, মান্থলি এবং ইয়ারলি ওয়ার্ক ক্যালেন্ডার তৈরি করেন দেখবেন আপনার কাজগুলো অনেক সহজ হয়ে গেছে। (চলবে)
লেখক: প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা, স্টার সিনেপ্লেক্স