নিজস্ব প্রতিবেদক : পূর্ণ আয়ুর্বেদ প্রতিষ্ঠিত না হলে পূর্ণসুখ, পূর্ণস্বাস্থ্য, পূর্ণজ্ঞান ও পুর্ণবিজ্ঞান ফিরে পাবো না’ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’।
উপক্রমণিকা: আয়ুর্বেদ শব্দটি দুটি সংস্কৃত শব্দের সংযোগে সৃষ্টি; ‘আয়ুষ’ অর্থ জীবন এবং ‘বেদ’ অর্থ বিজ্ঞান। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আয়ুর্বেদের অর্থ হলো ‘জীবনের বিজ্ঞান’। শরীর ও প্রাণের যোগই জীবন। তাই জীবনের রোগ নিরাময় করাই এর মূল লক্ষ্য। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রোগরোধ ও তার সঠিক নিরাময় আয়ুর্বেদের মূলমন্ত্র। আয়ুর্বেদ পৃথিবীর প্রাচীনতম আয়ুর্বিজ্ঞান। আয়ুর্বেদের ইতিহাস আমাদের উন্নতি ও সভ্যতার ইতিহাস। এটি শুধু চিকিৎসা শাস্ত্র নয়, বরং জড় ও জীবশক্তির সমন্বয় ও সামঞ্জস্য রক্ষা করে। জনশ্রুতি মতে, ৫০০০ বছরেরও অধিক প্রাচীনকাল থেকে ভারত উপমহাদেশে উদ্ভাবিত জীবনশৈলীভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতির নাম ‘আয়ুর্বেদ’। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, খ্রিস্টীয় ১ম শতকে রচিত চরক সংহিতায় আয়ুর্বেদ শব্দের প্রথম ব্যবহার হয়। এতে পরিস্কারভাবে বলা যায় যে, বৈদিক আমলের বেদের সাথে আয়ুর্বেদের সামান্যই যোগসূত্র রয়েছে। আয়ুর্বেদে প্রাকৃতিক ৩টি উৎস যথা উদ্ভিদ, প্রাণি ও খনিজ পদার্থ থেকে ঔষধ প্রস্তুত করে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য প্রয়োগ করা হয়। আয়ুর্বেদ আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ।
আয়ুর্বেদে আয়ুকে মোট ৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সুখায়ু ও দুঃখায়ু এবং হিতায়ু ও অহিতায়ু। যে আয়ু সুখময় এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে নিরোগ তা-ই সুখায়ু; এর বিপরীতটি দুঃখায়ু। আর যে আয়ু দিয়ে মানুষের হিত বা কল্যাণ হয়, সত্য ও সৎপথ নির্ধারিত হয় তা-ই হিতায়ু; এর বিপরীতটি অহিতায়ু। আয়ুর্বেদের লক্ষ্য সুখায়ু ও হিতায়ু সৃষ্টি করা।
আয়ুর্বেদে স্বাস্থ্য ভাবনার মূল ভিত্তি: আয়ুর্বেদে জীবনকে ভাবা হয় দেহ, অনুভূতি, মন ও আত্মার সমন্বয় হিসেবে। মানব দেহের সুস্থতা এবং অসুস্থতা সম্পূর্ণ নির্ভর করে দেহে উপস্থিত নানাবিধ খনিজ উপাদানের ভারসাম্য ও স্থিতির উপর। শরীরের অন্তর্নিহিত বা বাহ্যিক বিভিন্ন কারণের জন্য এই ভারসাম্যে তারতম্য আসার জন্য অসুখের জন্ম হয়। এই ভারসাম্যের অভাব ঘটতে পারে আমাদের ভুল খাদ্যাভ্যাসে এবং ত্রুটিপূর্ণ জীবনযাপন বা দৈনন্দিন জীবনে কুঅভ্যাসের জন্য। ঋতুর অস্বাভাবিকতা, ভুলভাবে ব্যায়াম বা ইন্দ্রিয়ের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং দেহ ও মনের অমিলপূর্ণ ব্যবহারও ভারসাম্যের বিঘ্নতা ঘটায়। তাই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো সঠিক খাদ্য, জীবনযাত্রা ও স্বভাবের উন্নতির দ্বারা শরীর ও মনের ভারসাম্য বজায় রাখা। আয়ুর্বেদিক ঔষধ গ্রহণ, পঞ্চকর্মের মাধ্যমে জৈব পদ্ধতিতে শরীরকে টক্সিনমুক্ত করা এবং রসায়ন চিকিৎসার দ্বারা দেহের ভাইটাল ফোর্সের উন্নয়ন ঘটানো এর শেষ ধাপ।
আয়ুর্বেদ মতে, মানবদেহ ৫টি ভৌত উপাদান (মাটি, পানি, আগুন, বায়ু ও আকাশ) দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ এই ৫টি ভৌত উপাদানে যা যা আছে, মানুষের দেহে তার সবকটি বিদ্যমান। তাই এসব ভৌত উপাদানসমূহের ভারসাম্য নষ্ট হলে শরীরে ত্রিদোষ দেখা দেয় এবং রোগের সৃষ্টি হয়। ত্রিদোষের অর্থ দেহে বায়ু, পিত্ত ও কফের ভারসাম্যহীনতা। উদ্ভিদ, প্রাণি ও খনিজ দ্রব্যের সমন্বয়ে প্রস্তুতকৃত ঔষধ ও খাদ্য দিয়ে ত্রিদোষ নিরসনের মাধ্যমে রোগ নিরাময় করা হয়। প্রথমে পঞ্চকর্ম প্রয়োগের মাধ্যমে শরীরের বিষাক্ত পদার্থসমূহ (Toxins) বের করে দিয়ে ঔষধ প্রয়োগ করা প্রাচীন আয়ুর্বেদের মৌলিক চিকিৎসা পদ্ধতি। আয়ুর্বেদে মানুষ এবং পশু-পাখির চিকিৎসা করা যায়।
অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ: আয়ুর্বেদ শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রাচীন আমল থেকে সৃষ্টি হলেও এর রয়েছে চিরন্তন বিজ্ঞানভিত্তিক অবয়ব। যখন চিকৎসা ও বিজ্ঞান পৃথিবীতে অনুপস্থিত ছিলো, তখন আয়ুর্বেদের উপর রচিত বই, গবেষণার ধরণ এবং উদ্ভাবন দেখলে বিস্মিত হতে হয়। আজ থেকে প্রায় ২,০০০ বছর আগে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ রূপ দেওয়ার জন্য একে ৮টি বিভাগে ভাগ করা হয়। এইজন্য আয়ুর্বেদকে নাম অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদও বলে। নিচে এই বিভাগগুলি উল্লেখ করা হলো:
১) শল্যতন্ত্র (সার্জারি)
২) শালাক্যতন্ত্র (নাক, কান, গলা ও চক্ষু)
৩) কায়চিকিৎসাতন্ত্র (জেনারেল মেডিসিন)
৪) ভুতবিদ্যাতন্ত্র (সাইকিয়াট্রি)
৫) অগদতন্ত্র (টক্সিকোলজি)
৬) কুমারভৃত্ত¡তন্ত্র (পেডিয়াট্রিও গাইনোকলজি)
৭) রসায়নতন্ত্র (ইমিউনোলজি ও জড়া চিকিৎসা)
৮) বাজিকরণতন্ত্র (যৌন ও প্রজনন চিকিৎসা)
আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতিতে উপর্যুক্ত বিভাগগুলি থেকে সহজেই এর আধুনিকতা সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। আজকের দিনে এর প্রত্যেকটি বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা হচ্ছে। আয়ুর্বেদের অতিকথন (Myth)আয়ুর্বেদ সম্বন্ধে জনশ্রুতিতে অনেক অতিকথন প্রচলিত রয়েছে। যেমন অনেকেই না জেনে অথবা ভুল জেনে আয়ুর্বেদ সম্পর্কে বিজ্ঞের মতো ভুল ব্যাখ্যা দেন। প্রথম অতিকথন হলো আয়ুর্বেদিক ঔষধ দেরিতে কাজ করে। আয়ুর্বেদিক ঔষধ দেহের সিস্টেমের উপর কাজ করে মূলত রোগের মূলোৎপাটন করে, যা এলোপ্যাথিক ঔষধ করে না। তাই মূলোৎপাটনের জন্য একটু সময় তো দিতেই হবে। সবচেয়ে মারাত্মক ২টি অতিকথন সর্বত্র প্রচারিত। প্রথমত সনাতন ধর্মের অবতারদের মাধ্যমে আয়ুর্বেদ পৃথিবীতে এসেছে। দ্বিতীয়ত মুসলমানগণ এই গল্প বিশ্বাস করে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো পৃথিবীতে বর্তমান ২৫৪টি ধর্মের (Religions) মধ্যে কোন ধর্মেরই নিজস্ব কোন চিকিৎসা পদ্ধতি নাই। সনাতন ধর্মের অবতারদের মাধ্যমে স্বর্গ থেকে এই চিকিৎসা পদ্ধতি পৃথিবীতে আসলে আয়ুর্বেদের কোন ইতিহাস থাকতো না। প্রায় ১,৩০০ বছর পৃথিবীর মানুষকে আয়ুর্বেদিক ঔষধে কেবল খনিজ পদার্থসমূহের সংযুক্তি নিয়ে গবেষণা করতে হতো না। আসলে এ সবই মূর্খতা, না জানার ফল। উল্লেখ্য যে, অথর্ববেদে কেবল ২৮৯টি ভেষজ উদ্ভিদের নাম পাওয়া যায়। অথচ বাস্তবে ভেষজ উদ্ভিদের সংখ্যা কয়েক হাজার, যা এখন চিকিৎসা কার্যে ব্যবহার করা হয়।
আয়ুর্বেদের স্বর্ণযুগ ও ইতিহাস: অধ্যাপক বালিয়াথানের মতে খ্রিস্টীয় ১ম থেকে ৮ম শতকের মধ্যে সংহিতা পর্যায়টি ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের স্বর্ণযুগ বলে বিবেচিত। এই সময়ে চরক সংহিতা (খ্রিস্টীয় ১ম শতক) যা ঋষি অগ্নিভেশ রচিত আয়ুর্বেদের উপর একখানি গ্রন্থের সংস্করণ। মূল বইটি আরো কয়েক শতক আগে রচিত হয়েছিল এবং এই সংস্করণটি সম্পাদনার কাজ করেন চরক। শুশ্রুত সংহিতা (খ্রিস্টীয় ২য়-৩য় শতক) বইটি নাগার্জুনা দ্বারা সম্পাদিত শল্যচিকিৎসার ওপর একটি গ্রন্থ। বলা হয়, মূল বইটি সুশ্রুত রচনা করেন খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতকে। অষ্টাঙ্গ সমগ্র ও অষ্টাঙ্গ হৃদয় ( খ্রিস্টীয় ৮ম-৯ম শতক) রচনা করেন ভাগবত। উল্লেখ্য যে, সংহিতা অর্থ বই।
চরক সংহিতায় প্রথম ‘আয়ুর্বেদ’ শব্দটির প্রচলন শুরু হয়। শুধু তাই নয়, এখানেই প্রথম বিষয়টির বিশ্বাস নির্ভরতা থেকে যুক্তি নির্ভরতায় উত্তরণ ঘটে। ওষুধপত্রের বিস্তারিত আলোচনা ছিল এই গ্রন্থের মূল বৈশিষ্ট্য। দুই থেকে তিন শতাব্দীর মধ্যে এটি পার্সী, আরবী ও তিব্বতী ভাষায় অনূদিত হয় এবং মধ্য এশিয়াতে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মধ্য এশিয়ায় এর প্রমাণ হিসেবে Bower Manuscript খুঁজে পাওয়া যায়। Bower ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত থাকাকালীন মধ্য এশিয়ার কিছু অধিবাসীদের কাছ থেকে চরক সংহিতার পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে জমা দেন। খ্রিস্টীয় ১৯ শতকে চরক সংহিতা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। অতপর ২১ শতকেও কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়ামাশিতা এর ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, চরক সংহিতা কায়চিকিৎসা বা আয়ুর্বেদিক মেডিসিনের পুস্তক।
নাকের প্লাস্টি অস্ত্রোপচার বা রাইনোপ্লাস্টির (Rhinoplasty) সাথে সুশ্রুতের নাম অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। রাইনোপ্লাস্টি গত ৩ হাজার বছর আগে ভারত থেকে ছড়িয়ে পড়া বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত একমাত্র অস্ত্রোপচার পদ্ধতি। উল্লেখ্য, সুশ্রুত সংহিতা শল্যচিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের পুস্তক। এখানে অস্ত্রোপচার পদ্ধতি, যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র এবং অস্ত্রোপচার সংক্রান্ত মানসিক আঘাতের পরিচর্যা নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে। ভারতের বাইরেও সুশ্রুত সংহিতার বেশ কদর ছিল। খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি আরবী ভাষাতেও অনূদিত হয় এবং এই কাজের জন্য বেশ কিছু ভারতীয় চিকিৎসক বাগদাদে ছিলেন বলেও মনে করা হয়।
ইতিহাস পর্যালোচনান্তে আরো প্রতীয়মান হয় যে, চরক ও সুশ্রুত সংহিতা তৎকালীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হতো। সেখান থেকে অগণিত ছাত্রের হাত ধরে এই পুস্তক দুটি ও এদের অনুবাদ চীন, তিব্বত ও অন্যান্য পূর্ব এশীয় দেশে পাড়ি জমায়। ফলে আজও চিকিৎসা বা দর্শন সংক্রান্ত অনেক প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রের চীনা ও তিব্বতী অনুবাদ পাওয়া যায়। আচার্য পি. সি. রায় এর মতে, আনুমানিক ৮ম-৯ম শতকে যখন আয়ুর্বেদের বিকাশের পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন ভাগবত ‘অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ’ এবং ‘অষ্টাঙ্গ হৃদয়’ রচনা করেন। এই দুটি বই চরক এবং সুশ্রুতের শিক্ষাকে প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং সহজে ও সংক্ষেপে উপস্থাপনা করে।
আয়ুর্বেদের শক্তি: ১৯১০ সালে কলকাতা থেকে ছাপানো আয়ুর্বেদের এক বিশাল বইয়ে পড়েছিলাম যে, Ayurveda is the Science of all Life Sciences। এতো বড় একটি বাক্য পড়ে ধাক্কা খেয়েছিলাম। পড়ে আয়ুর্বেদ সম্বন্ধে যৎসামান্য জ্ঞান অর্জন করে তার সত্যতা অনুভব করেছি। এটি এতো বড় সত্য যে, গত ১১০ বছরে কেউ এর প্রতিবাদ করার সাহস দেখালো না।
জেনে অনেকেই অবাক হবেন যে, ডি এস রিসার্চ সেন্টার নামে একটি আয়ুর্বেদিক ক্যান্সার চিকিৎসার চেইন হসপিটাল রয়েছে ভারতে। সারা ভারতে এদের ৬টি হসপিটাল আছে, যার একটি কলকাতায়। উল্লেখ্য যে, এরা পেলিয়েটিভ বা প্রশমন চিকিৎসা করে না। ৩য় গ্রেড পর্যন্ত ক্যান্সারের চিকিৎসা করে। স্ট্রোক করে প্যারালাইসিস হলে পঞ্চগড়ের শওকত কবিরাজের কাছে যাচ্ছেন শত শত মানুষ। অবাক হওয়ার বিষয় এই যে, অনেক সিভিল সার্জন তার কাছে রোগী প্রেরণ করেন। ঢাকার বৈদ্য নূর আলম সফলভাবে আর্থ্রাইটিসসহ নানা ধরণের জটিল রোগের চিকিৎসা করেন। অর্থাৎ ব্যাধির (Disorders) চিকিৎসা যতটুকু হয় সেটা কেবল আয়ুর্বেদে। নিউরোলজিক্যাল ৩-শতাধিক রোগের চিকিৎসা আয়ুর্বেদ ছাড়া সম্ভব নয়। চোখের অন্তত ২৪টি জটিল রোগের চিকিৎসা করা হয় দক্ষিণ ভারতে বিশ্ববিখ্যাত আয়ুর্বেদিক চক্ষু হসপিটাল শ্রীধারীয়ামে। আয়ুর্বেদ ছাড়া আর কেউ এইসব চক্ষু রোগের চিকিৎসা করতে পারেন বলে আমি জ্ঞাত হতে পারি নাই। আয়ুর্বেদে ব্যবহৃত মুক্তাভষ্ম ব্যতীত আর কেউ ফর্সা করতে পারবে না। আইবিএস-এর জন্য কান্ত লৌহ ভষ্ম অত্যন্ত কার্যকর। আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত লৌহভষ্ম এলোপ্যাথিক আয়রন সিরাপের চেয়ে উত্তম, তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। অথচ শুধু না জানার কারণে আমরা প্রতিনিয়ত যে সকল সংকটে পড়ছি তা থেকে মুক্তির জন্য অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে আয়ুর্বেদের কাছে ফিরেও যেতে পারছি না।
আয়ুর্বেদে বায়ু, পিত্ত ও কফের ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য রক্ষার মন্ত্রটি গণমানুষকে শিখিয়ে দিলেই আমাদের জনস্বাস্থ্য রক্ষা পাবে। আয়ুর্বেদ আহার (অর্থাৎ খাবারের পরিমাণ, সময় এবং উপাদান) ও বিহার (অর্থাৎ জীবনধারা) মেনে নিরোগ থাকা যায়। আয়ুর্বেদ মতে, বডি টাইপ অনুযায়ী পৃথিবীতে ৯ (নয়) ধরণের মানুষ আছে এবং এদের প্রত্যেকের ডায়েট ভিন্ন। বলাই বাহুল্য যে, এসব না জানার জন্য আমরা সবাই এক ধরণের খাবার খেয়ে প্রতিনিয়ত অনিরাময়যোগ্য জটিল ব্যাধিতে (Disorder) আক্রান্ত হচ্ছি। আমরা আজকাল স্বাস্থ্যবিধি বলতে বুঝি, ফরমালিনমুক্ত খাবার, লাইফবয় দিয়ে হাত ধোয়া, সেনিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা আর টিস্যু পেপার দিয়ে দৃশ্যমান ময়লা পরিস্কার করা। গায়ে একটু তাপ বাড়লেই ডাক্তারের কাছে যাই প্রেসক্রিপশন কেনার জন্য। তারপর হাজার টাকার টেস্ট ও দামি এন্টিবায়োটিকের ফাঁদে বাধা পড়ি। উল্লেখ্য যে, আয়ুর্বেদে পায়খানা ও প্রস্রাব পরীক্ষার পদ্ধতি এবং নাড়ী স্পর্শ করে রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি অতি প্রাচীন ও কার্যকর। মজার ব্যাপার যে, আয়ুর্বেদ মতে শুধু নাড়ী টিপেই বলে দেওয়া যায় অনেক রোগ-ব্যাধির কথা; যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হার্টের ব্লক ইত্যাদি। এই বিষয়ে Secrate of Pulse নামক ২২৩ পাতার একটি যুগান্তকারী বই ভারত থেকে সংগ্রহ করে ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছাপা হয়। বইটি সত্যিই বিস্ময়কর। বয়োজ্যেষ্ঠদের জড়া ব্যবস্থাপনা ও খাদ্যের রেসিপি নির্মাণে রয়েছে আয়ুর্বেদের সরব পদচারণা।
আরো মজার ব্যাপার যে, গত ২২ এপ্রিল ২০২০ তারিখে আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অলটারনেটিভ মেডিক্যাল কেয়ারের লাইন ডাইরেক্টর ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার সাথে সম্পৃক্ত সকল কর্মকর্তাদেরকে প্রচারের অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়েছে যে, আদা ও লবঙ্গ মিশ্রিত গরম পানি, কালোজিরা/মধু, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল গ্রহণ করুন যা করোনা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। হাল আমলে এমন একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তি সংগত কারণেই আমাদেরকে নতুনভাবে উৎসাহিত করে।
আমাদের অসহায়ত্ব: প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে আয়ুর্বেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের দেশেও এই শিক্ষা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে নামমাত্র সরকারি স্বীকৃতি রয়েছে। বর্তমানে ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালনা করা হয় অনেকগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। আর হাতে গোনা ২-৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি কোর্স। তবে কোনভাবেই এর শুদ্ধ শিক্ষা ও অনুশীলন চর্চিত হচ্ছে না। ফলে জনস্বাস্থ্যে এর ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
ভারতে ৪টি আয়ুর্বেদিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন শত শত কলেজে আয়ুর্বেদে উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। আর আমাদের দেশে কেবল একটি সরকারি কলেজ দীনহীনভাবে এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জোড়াতালি দিয়ে ব্যাচেলর অব আয়ুর্বেদিক মেডিসিন এন্ড সার্জারি (BAMS) ডিগ্রি দিচ্ছে। অন্য আরো ২-১টি বেসরকারি কলেজে সম্প্রতিকালে আয়ুর্বেদে ডিগ্রি কোর্স চালু করা হয়েছে। দেশে একটি আয়ুর্বেদিক হাসপাতাল না থাকার জন্য এদের ইন্টার্ণশীপ হয় না, হলেও এলোপ্যাথিক হসপিটালে। অতি পরিতাপের বিষয় যে, ১১ (এগার) টি আয়ুর্বেদিক ডিপ্লোমা কলেজ চলছে বড়ই বেহাল অবস্থায়। এদেরও কোন ইন্টার্ণশীপ হয় না। এই শিক্ষা ব্যবস্থাটি এমন একটি নাজুক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যে প্রতিনিয়ত বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এর মান নিয়ে কারো কোন মাথাব্যাথা নাই, নজর নাই, পৃষ্ঠপোষকতা নাই। চরম অবহেলায় চলছে আমাদের আয়ুর্বেদ।
উত্তরণের উপায়: আয়ুর্বেদের উত্তরণের জন্য এখনো অনেক পথ খোলা। তবে প্রায় অধিকাংশগুলিই সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নিচে তার কিছু উল্লেখ করা হলো:
ক) আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন এমন উপকারভোগী সাধারণ মানুষের সিটিজেন চার্টার ঘোষণা করা উচিত।
খ) সরকারের উচিত অবিলম্বে কমপ্লিমেন্টারি এন্ড অলটারনেটিভ মেডিসিন পলিসি ঠিক করে আয়ুর্বেদকে মূলধারার চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।
গ) আমাদের দেশের বর্তমান ভেষজ উদ্ভিদের সংরক্ষণ, গবেষণা ও বিস্তারের জন্য অবিলম্বে ‘ন্যাশনাল মেডিসিনাল প্ল্যান্ট বোর্ড’ গঠন করা জরুরি এবং এর অধীন একটি ‘মেডিসিনাল প্ল্যান্ট জার্মপ্লাজম সেন্টার’ স্থাপন করা আবশ্যক।
ঘ) বাংলাদেশে অন্তত একটি পাবলিক আয়ুর্বেদিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত। অতপর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন প্রতিটি বিভাগীয় শহরে এবং পরে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে সরকারি আয়ুর্বেদিক ডিগ্রি কলেজ স্থাপন করা জরুরি।
ঙ) শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে ‘জাতীয় আয়ুর্বেদিক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করা উচিত।
চ) আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা, আয়ুর্বেদিক শিক্ষা ও আয়ুর্বেদিক ঔষধ প্রস্তুতি নিয়ে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা উচিত।
ছ) ঔষধ প্রশাসনে আয়ুর্বেদে শিক্ষিত ও আন্তরিক জনবল পদায়ন করতে হবে।
জ) মেধাবী ছাত্রদেরকে আয়ুর্বেদ শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃত্তি, আর্থিক প্রণোদনা ও বিনা বেতনে আয়ুর্বেদ শিক্ষার উদার ব্যবস্থা চালু করা উচিত।
উপরের কাজগুলি করতে ব্যর্থ হলে আগামী দিনে জনস্বাস্থ্যের সংকট মোকাবেলায় আমাদেরকে প্রমাদ গুণতে হবে। আয়ুর্বেদিক শিক্ষা, চিকিৎসা ও ঔষধের মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কোন বিকল্প নাই। কারণ এর উপকারভোগী সাধারণ মানুষ, অন্য কেউ নয়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন আয়ুর্বেদিক ঔষধ প্রস্তুতিতে স্বল্প উপাদান দিয়ে এবং স্বীকৃত পদ্ধতি পরিহার করে কেউই শর্টকাট মেথডে তা উৎপাদন না করেন। তা না হলে আসব ও অরিষ্ট জাতীয় ঔষধ উৎপাদন, ঔষধে খনিজ ভষ্ম (Mineral ashes) ব্যবহার ইত্যাদি যথানিয়মে পরিচালিত হবে না।
উপসংহার: বাংলাদেশে এখনো চিরায়ত চিকিৎসা গ্রহণ করেন এমন মানুষের সংখ্যা ৮৫%-এরও বেশি। আয়ুর্বেদ এদেশে পরীক্ষিত, স্বীকৃত ও অন্যতম চিরায়ত চিকিৎসা ব্যবস্থা। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও জীবনমুখী অনুশীলন দ্বারা পরিচালিত। এ কথা সত্য যে, আমরা প্রকৃতির সন্তান এবং তারই অংশ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক কোন কাজই আমাদের জন্য মঙ্গলময় নয়, বরং অনেক বেশি ক্ষতিকারক। তাই আমাদেরকে ফিরতে হবে প্রকৃতির কাছে। আধুনিকতার নামে কৃত্রিম খাদ্য, কৃত্রিম উপাদান দিয়ে চিকিৎসা আমাদের শরীরের উপর অত্যাচারেরই নামান্তর। তাই এইসব পরিহার করে আয়ুর্বেদের মতো প্রাকৃতিক ও পরীক্ষিত জীবনশৈলী অনুশীলন করতে হবে। শিক্ষা, গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর উৎকর্ষ সাধনের সময় এসেছে। এই শিক্ষা গ্রহণ না করলে আমাদের মানবিক বিপর্যয় অনিবার্য।